Le hazard ne favorise que les espirits prepare: Louis Pasteur
There are so many other things left to discover: Ralph Steinman
আমার কিছু কথা : ২০০৭ সালে অগ্নাশয়ে ক্যান্সার শনাক্ত হবার পর র্যালফ মার্ভিন স্টাইনম্যান, ক্যান্সার এবং রোগ প্রতিরোধ সম্বন্ধে তার নিজের তত্ত্বকেই পরীক্ষা করে দেখেছিলেন নিজের শরীরের উপর। নিজের এই চিকিৎসাটাই তাকে বাচিয়ে রেখেছিল, ডাক্তাররা যা ধারনা করেছিলেন, তার চেয়েও বেশ অনেক দিন বেশী। কিন্তু নোবেল পুরষ্কারে খবর পৌছানোর ঠিক তিন দিন আগে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। প্রথা ভঙ্গ করেই মরনোত্তর নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয় এই অসাধারন বিজ্ঞানীকে। এই লেখাটি তাকে নিয়ে। র্যালফ স্টাইনম্যান এবং তার নোবেল পুরষ্কার এবং আবিষ্কার নিয়ে বাংলা ভাষী ব্লগে ইতিমধ্যে দুটি চমৎকার লেখা প্রকাশিত হয়েছে, দুই তরুন বিজ্ঞানীর লেখা (এক | দুই ); এটি আমার জানামতে তৃতীয়। স্টাইনম্যান প্রথম বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি ডেনড্রাইটিক কোষ এবং এর কাজের বিবরন দিয়েছিলেন। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, এই ডেনড্রাইটিক কোষটি আসলে কি? আমাদের শরীরে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন একটি কাজের সাথে এরা জড়িত। আমাদের শরীরকে নানা রোগ জীবানুর আগ্রাসন এবং বেপরোয়া হয়ে যাওয়া নিজেদের কোষ থেকে যে প্রক্রিয়াটি আমাদের সুরক্ষা করে, সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউন সিস্টেমের খুবই গুরুত্বপুর্ণ কিছু ভুমিকা পালন করে এই কোষটি। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধে নিয়োজিত প্রধান কোষগুলোকে এই কোষটি শিক্ষা দেয়, কার বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ করতে হবে। সত্তরের দশকে আবিষ্কার হওয়া এই কোষটি এখন ক্যান্সার এর থেরাপিউটিক ভ্যাক্সিন এবং আরো অগনিত পরীক্ষামুলক ভ্যাক্সিনের গবেষনার একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান করছে। ডেনড্রাইটিক কোষের সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৭-২০০০ সালে ভাইরোলজীর ছাত্র থাকা অবস্থায়; বিশেষ করে দ্বিতীয় পর্বে ইমিউনোলজী এবং থিসিসের এইচআইভি নিয়ে কাজ করার সময়। ২০০০ সালে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো তখন স্পটলাইটে, বিশেষ করে হেটেরোসেক্সুয়াল যৌন সঙ্গমের সময় যোনী পথের মিউকোসা থেকে এ্ইচআইভি ভাইরাসের এই কোষগুলোকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে শরীরে ঢোকার প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার পর। ২০০৩ এ একটা সংক্রামক ব্যাধি সংক্রান্ত ট্রেনিং এর দীর্ঘ অনেকগুলো সেশন ছিল ডেনড্রাইটিক কোষের উপর, সেখানেই স্টাইনম্যানের এই কোষটিকে প্রকৃত মুল্যায়ন করার কাহিনীটা শুনি এক সুইস ডেনড্রাইটিক কোষ বিজ্ঞানীর লেকচারে। সব বিজ্ঞানীদের প্রতি আমার বাড়তি একটা শ্রদ্ধাও যেমন আছে, তেমন খানিকটা ঈর্ষা। কারন আমিও বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম, এইচআইভি নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলাম, বেশ কবার চেষ্টাও করেছিলাম নিজ দেশে, পারিনি। সরকারী চিকিৎসা ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে সেই সময় এই স্বপ্ন দেখা হয়তো ঠিক হয়নি, এই হেরে যা্ওয়াটা আমার জীবনে অনেক কিছু বদলে দিয়েছে। যারা হারেনি যারা এখনও গবেষনা করে যাচ্ছেন তাদের সবার প্রতি আমার ক্ষমাযোগ্য সামান্য ঈর্ষা মিশ্রিত শুভকামনা।
একজন বিজ্ঞানী এবং একটি অসাধারন কোষ:
র্যালফ স্টাইনম্যান রোগপ্রতিরোধবিজ্ঞান বা ইমিউনোলজীর অনেক কিছুই বদলে দিয়েছিলেন। সত্তরের দশকের শুরুতে তার আবিষ্কার করা ডেনড্রাইটিক কোষের গুরুত্ব মেনে নিয়ে অনেক সময় নিয়েছে ইমিউনোলজীর সুবিশাল ক্ষেত্রটি। মলিকিউলার সেল বায়োলজীর সেই যুগে কেউ যে মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে নতুন একটি রোগপ্রতিরোধকারী কোষ আবিষ্কার করতে পারে, এটা সহজে মেনে নেয়া কঠিন ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। গবেষনার প্রথমদিকে তাকে মুখোমুখি হতে হয়েছে খুবেই কঠিন সমালোচনার। মৃত্যুর মাত্র তিন দিনের মাথায় নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার পথটাও খুব সহজ ছিল না। তার অসাধারন ব্যক্তিত্ব, প্রানশক্তি আর আত্মবিশ্বাস আর একাগ্রতা তাকে সহায়তা করেছে এই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে।
১৯৪৩ সালে কানাডার কুইবেক এর শেরব্রুকে এক অভিবাসী ইহুদী পরিবারে তার জন্ম। তার পুর্বপুরুষরা এসেছিলেন পোল্যান্ড এবং মলদোভা থেকে। বাবা মা’র ইচ্ছা ছিল ছেলে ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করবে ছেলে এবং পারিবারিক জেনারেল স্টোর ’মোজার্ট’, যেখানে কাপড় থেকে শুরু করে গৃহস্থালী সব যন্ত্রপাতিও বিক্রি হতো, তার দেখাশুনা করবে। গ্রীষ্মের ছুটিগুলোতে পারিবারিক দোকানে কাজ করার সময়ই তিনি বুঝতে পারেন, এই কাজটি তাকে দিয়ে হবেনা, অন্য কিছু হতে চান তিনি।
বিজ্ঞানের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসা তাকে প্রথমে মন্ট্রিওলের ম্যাকগীল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে বোষ্টনে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে নিয়ে আসে। ম্যাকগিলে আসার পরেই বায়োলজীর প্রতি আরো আকৃষ্ট হন তিনি। এরপর বোষ্টনে মেডিকেলে পড়ার সময় ৬০ এর দশকের শেষের দিকে, তার সুযোগ হয় ইমিউনিটির শুরু সম্পর্কে কার্ট ব্লশ এর লেকচার শোনার, পিটার মেদাওয়ার এর টলারেন্স মেকানিজম ( রোগ প্রতিরোধ কারী কোষগুলোর সহনশীলতা) এবং ম্যাকফারলেন বুরনেট এর ক্লোনাল সিলেকশন সম্বন্ধে পড়াশুনা করার। ডাক্তার হবার জন্য ম্যাসাচুসেট জেনারেল হাসপাতালে রেসিডেন্সি শেষ করলেও পেশা হিসাবে চিকিৎসক হওয়াটাকে বেছে নেননি তিনি; মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষনার প্রতি তার তীব্র আগ্রহ বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধ কারী কোষগুলোর ক্ষুদ্র রহস্যময় জগত, অবশেষে তাকে নিয়ে যায় জানভিল কোন এবং জেমস হার্শ এর রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনাগারে, রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার সুচনা কিভাবে হয় সেই প্রশ্নটির উত্তর খুজতে।
সেই সময় বিজ্ঞানীরা আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার নানা মুল উপাদানগুলোর মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্কগুলোর রহস্য সমাধানে ব্যস্ত। বিজ্ঞানীরা ততদিনে জেনে গেছেন, আমাদের রক্তের শ্বেত রক্ত কনিকারা: যেমন বি কোষ বা বি লিম্ফোসাইট, যারা আমাদের শরীরে বাইরে থেকে আসা, আগ্রাসী বহি:শত্রুকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে তাদের নিঃসরন করা অ্যান্টিবডি দিয়ে এবং অন্য আরেক ধরনের শ্বেত রক্তকনিকা, টি কোষ বা টি লিম্ফোসাইট, যারা সেই আগ্রাসন কারীদের সরাসরি আক্রমন করে। কিন্তু বিজ্ঞানীর জন্য যা তখন প্রধান যে প্রশ্নটি ছিল তা হলো, বি কোষ এবং টি কোষগুলোকে কে এই কাজ করার জন্য সক্রিয় করে তুলছে।
কোন এবং হার্শ দুজনেই তখন ভাবছিলেন, রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়াটা শুরু করে মাক্রোফেজ ( একটি শ্বেত রক্ত কনিকা), কিন্তু সে সময় স্টাইনম্যানের উপর প্রভাব ফেলেছিল তার ল্যাবের কয়েক ফ্লোর উপরে কাজ করা একদল বিজ্ঞানী: ক্রিষ্টিয়ান দ্য দুভে, জর্জ প্যালাডে, ফিলিপ সিয়েকিভিজ, ডেভিড সাবাতিনি এবং গুনটার ব্লোবেল, যারা আধুনিক সেল বায়োলজীর সুচনা করছিলেন তখন। স্টাইনম্যান সেই সময় কিভাবে কোষ তার ভেতরে বাইরের পরিবেশ থেকে কোন কিছুকে আত্মস্ত বা ইনজেষ্ট করে নেয় সেই পক্রিয়াটির প্রথম ব্যাখ্যা করেন, যা এন্ডোসাইটোসিস বলে পরিচিত এবং কোনের সাথে যৌথভাবে প্রস্তাব করেন এই প্রক্রিয়ায় কিভাবে কোষের পর্দা বহুব্যবহৃত বা রি সাইকেল হচ্ছে।
১৯৭০ এর দশকে কেবল তখন রোগ প্রতিরোধের সাথে সংশ্লিষ্ট কোষগুলো কিভাবে কাজ করে (সেলুলার ইমিউনিটি) ভালোভাবে গবেষনা করার জন্য কেবল কালচার প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষনগুলো তখন ইঙ্গিত করছিল, মুল বি এবং টি কোষ বা লিম্ফোসাইটগুলো (লিম্ফোসাইটও এক ধরনের শ্বেত রক্ত কনিকা) ছাড়াও আরো একধরনের কোষ এর সাথে জড়িত, প্রথমে যাদের নামকরণ করা হয় অ্যাক্সেসরি বা অতিরিক্ত কোষ, এই কোষগুলো কালচার প্লেটে কাচের সাথে আটকে থাকতো, সেকারনে স্টাইনম্যান, তার সেল বায়োলজীর সহকর্মীদের কাজ, যারা মাই্ক্রোস্কোপের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন; দেখে অনুপ্রানিত হয়ে কাচের সাথে লাগানো কোষগুলো মাইক্রোস্কোপের নীচে ভালো করে দেখার সিদ্ধান্ত নেন, এজন্য ফেজ কনট্রাষ্ট, জীবন্ত ইমেজিং এবং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ টেকনিক বেছে নেন।
এভাবে সত্তরের দশকে প্রথম দিকে একদিন, ম্যানহাটনের আপার ইষ্ট সাইডে রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের তার ল্যাবে কালচার প্লেটে কোষগুলোকে (মাউসের প্লীহা থেকে সংগ্রহ করা) মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে দেখতে গিয়ে র্যালফ স্টাইনমান খুজে পেয়েছিলেন এমন একটি কোষ, যা এর আগে ঠিক সেভাবে আর কারো নজরেই পড়েনি। স্টাইনম্যানের সেদিন মনে হয়েছিল, মাইক্রোস্কোপের নীচে তিনি যা দেখছেন সেটাই সম্ভবত বিজ্ঞানীদের এতদিন ধরে খোজা সেই প্রশ্নর উত্তর: অদ্ভুত, অসংখ্য দীর্ঘ, সরু হাত বিশিষ্ট কতগুলো কোষ, যে ধরনের কোষ তিনি আগে কোনদিনও দেখেননি।
মাইক্রোস্কোপের নীচেই তিনি দেখতে পান যার কোষ ঝিল্লী থেকে অসংখ্য সরু দীর্ঘ শাখা প্রশাখা সহ হাতের দ্রুত আকার পরিবর্তনশীল প্রজেকশান; পর পর তিনটি স্বতন্ত্র পরীক্ষায় স্টাইনম্যান বুঝতে পারলেন এই ডেনড্রাইটিক কোষগুলোই আসলে সেই অজানা অ্যাকসেসরী কোষ। কোন আগ্রাসী জীবানুর প্রতি প্রতিক্রিয়া হিসাবে এরাই টি কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভাজন ও আক্রান্ত কোষ ধ্বংশ করতে টি কোষকে সক্রিয় করার কাজটি করে এবং এই কোষটির জৈব রাসায়নিকভাবে মাক্রোফেজ থেকে আলাদা। অর্থাৎ তিনি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা পালনকারী সেই রহস্যময় কোষটি খুজে পেলেন।
শরীরের বাইরে কালচার করা পরিণত ডেনড্রাইটিক কোষ ( গাঢ় নীল, এমএইচসি অনুগুলো রন্জিত) (ছবি সুত্র)
কোষগুলো দেখে তার প্রথম যে ধারনাটা হয়েছিল, সেটাই পরবর্তী সঠিক প্রমানিত হয়েছিল। এই ডেনডাইট্রিক কোষগুলো (স্টাইনম্যান যেভাবে এদের নাম করন করেছিলেন)আমাদের শরীরে আক্রমনকারী কোন আগ্রাসী জীবানুকে শনাক্ত করতে এবং এদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়া সুচনা করতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে। কোষগুলো তদের দীর্ঘ হাতের মত কোষের উপাঙ্গকে ব্যবহার করে আমাদের শরীরের মধ্যে অযাচিতভাবে ঢুকে পড়া বহিশত্রুটাকে ধরে ফেলে এবং তাদের কোষের সাইটোপ্লাজমের ভিতর নিয়ে ঢুকিয়ে নেয় বা বলা যায় গিলে ফেলে এবং তা বহন করে নিয়ে যায় অন্য রোগ প্রতিরোধকারী বা ইমিউন কোষগুলোর কাছে; মুলত: এরা এই বিশেষায়িত রোগ প্রতিরোধ কারী কোষগুলোকে চেনায় এবং শিখিয়ে দেয় কোথায় এবং কাকে তাদের আক্রমন করতে হবে। এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, যা প্রথম বারের মত সুস্পষ্টভাবে বিজ্ঞানীদের বুঝতে সাহায্য করে রোগ প্রতিষেধক টীকা বা ভ্যাক্সিনগুলো আসলে কিভাবে কাজ করে, আর এই আবিষ্কারটি স্টাইনম্যানকে নিয়ে যায় তার পেশায় প্রথম সারিতে।
ডেনড্রাইটিক কোষ (সবুজ) এর সাথে টি কোষ ( লাল) এর ইন্টারঅ্যাকশন
এর পরের দশকগুলোতে স্টাইনম্যান ডেনড্রাইটিক কোষ বায়োলজীর ক্ষেত্রে প্রধান গবেষক এবং উৎসাহ দাতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকেন। তার অনুপ্রেরনায় বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে অনেক বিজ্ঞানীদের টেনে আনে ডেনড্রাইটিক কোষটি নিয়ে গবেষনার ক্ষেত্রে। বিভিন্ন জনের সাথে সহযোগীতা করতে খুব ভালোবাসতেন স্টাইনম্যান, ওয়েসলী ভ্যান বুরহিস এর সাথে যৌথভাবে তিনি দেখান শুধু কোষে না মানুষের রক্তেও ডেনড্রাইটিক কোষ থাকে, কায়ো ইনাবার সাথে তিনি দেখান যে যদি ডেনড্রাইটিক কোষকে টিউমারের অ্যান্টিজেন চেনানো যায় , তারা ইদুরের শরীরে টিউমারের বিরুদ্ধেও রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জেরার্ড শুলারের সাথে তিনি দেখান যে, কোন রোগজীবানু সরাসরি এই কোষগুলোকে সক্রিয় করে তুলতে পারে রোগ প্রতিরোধে প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য।
অসম্ভব দয়ালু এই মানুষটাকে তার সহকর্মীরা খুব ভালোবাসতেন, অসুস্থ অবস্থায়ও তিনি নিশ্চিৎ করে গেছেন তার অধীনে কাজ করা ছাত্র ছাত্রী এবং ফেলোরা যেন তাদের যোগ্য জায়গা খুজে পায় তার মৃত্যুর পর। বহু বছর ধরে তিনি জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল মেডিসিনের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেণ আনন্দের সাথে। তার আবিষ্কার যেন রোগীদের কাজে আসে, সেই লক্ষ্যে ডেনড্রাইটিক সেল ভ্যাক্সিন তৈরী করার প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তার নিজের ডিজাইন করা ডেনড্রাইটিক কোষ থেরাপী তিনি নিজের উপর পরীক্ষা করে ছিলেন।
এ পর্যন্ত হয়ত অনেকদিক থেকেই স্টাইনম্যানের গল্পটায় কোন বিশেষত্ব নেই: একজন মেধাবী বিজ্ঞানী, যিনি একটি গুরুত্বপুর্ণ আবিষ্কার করেন, যা অনুপ্রাণিত করে ভবিষ্যত প্রজন্মের অসংখ্য গবেষককে। কিন্তু স্টাইনম্যানের আলাদা করেছে তার অসাধারন অন্তর্দৃষ্টি ,যে অন্তর্দৃষ্টি যেমন প্রভাব ফেলেছে বিজ্ঞানে তার হাতে সৃষ্ট হওয়া নতুন একটি ক্ষেত্রে (ডেনড্রাইটিক সেল বায়োলজী), তেমনি ব্যক্তিগতভাবে তার নিজের জীবনে। যখন কেউই ডেনড্রাইটিক কোষ এর অস্তিত্ব মানতে চায়নি, তিনি তার বিশ্বাসে অটল ছিলেন, তিনি জানতেন এই কোষটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুগান্তকারী কিছু পরিবর্তন এনে দিতে পারে। ভবিষ্যতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষনায় দৃঢ় একটি জায়গা করে নিয়েছে তার আবিষ্কার করা এই কোষটি। আর এটাই তার প্রতি তার সহকর্মীদের নজীরবিহীন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার মুল কারন।
ডেনড্রাইটিক কোষ নিয়ে গবেষনা আরো খানিকটা এগিয়ে নেবার পর স্টাইনম্যান বুঝতে পেরেছিলেন, কান্সার থেকে এইচআইভি, বেশ কিছু ভয়ঙ্কর রোগকে শায়েস্তা করার জন্য এই কোষগুলো হতে পারে মোক্ষম অস্ত্র। তার নিজের দীর্ঘ দিনের গবেষনাতো বটেই এবং পৃথিবী জুড়ে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো নিয়ে তার সহযোগীদের গবেষনাও তাকে সঠিক প্রমান করার দিকে ক্রমশ এগিয়েও যাচ্ছিল;
ঠিক তখনই স্টাইনম্যানের কাহিনী অপ্রত্যাশিতভাবে মোড় নিল অন্যদিকে।
২০০৭ সালে স্টাইনম্যানের প্রানক্রিয়াস বা অগ্নাশয়ে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ভয়ঙ্কর আগ্রাসী যে ক্যান্সার সাধারনত: আক্রান্ত প্রতি পাচ জন রোগীর চার জনেরই জীবন কেড়ে নেয় এক বছরের মধ্যেই। জীবনের শেষ বছরগুলোতে, পেশাগত জীবনের শুরুতে যে কোষগুলো তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, সেই কোষগুলো এবং দীর্ঘ গবেষনা জীবনে গড়ে ওঠা বন্ধু সহযোগীদের শুধু তাকে সাহায্যই করেনি এই ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে, সব সম্ভাব্য ধারনাকে ভুল প্রমানিত করে তার জীবনকালও দীর্ঘায়িত করেছিল যথেষ্ট পরিমানে, আর এই বাড়তি সময়েই তিনি অর্জন করে নেন জৈবচিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অবদানের জন্য নোবেল পুরষ্কার।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তার নীরব মোবাইল ফোনে নোবেল জয়ের বার্তাটি শোকাহত পরিবারের কাছে পৌছায় মৃত্যুর মাত্র তিন দিন পরে।
প্রস্তুত মন:
ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বায়োলজী পড়া হয়নি স্টাইনম্যানের, কিন্তু বায়োলজী তার মনে বিশেষ একটা জায়গা করে নিয়েছিল, বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোর অতি ক্ষুদ্র অসাধারন একটি জগত তাকে ভীষন আকৃষ্ট করেছিল, যা পরবর্তীতে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পেশা থেকে নিয়ে আসে মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষনার জগতে।
জানভিল কোন এর ল্যাবে তার অফিসে টাঙ্গানো ছিল উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসী অনুজীববিজ্ঞানী এবং ভ্যাক্সিনোলজিষ্ট লুই পাস্তুরের বিখ্যাত একটি উক্তি: le hazard ne favorise que les espirits prepare, যা সাধারনত অনুদিত হয়, Chace favors the prepared mind, অর্থাৎ প্রস্তুত মনকেই সহায়তা করে ভাগ্য। র্যালফ স্টাইনম্যান এর প্রস্তুতি ছিল সন্দেহাতীত ভাবে অনেক বেশী। তার দীর্ঘ দিনের সহযোগী সারাহ স্লেশিংগার এর মতে এই প্রস্তুতিটাই তাকে তার অন্তদৃষ্টির উপর আস্থা রাখাটাকে সহজ করে দিয়েছিল। তার এই আত্মবিশ্বাস যেমন গুরুত্বপুর্ণ একটি আবিষ্কারের পথকে সুগম করেছে,তেমন শ্রদ্ধাও আদায় করে নিয়েছে তার সহকর্মীদের।
প্রথম বারের মত ডেনড্রাইটিক কোষগুলোকে শনাক্ত করার পর,স্টাইনম্যান পরের দুই দশক ধরে, এই কোষগুলো কিভাবে কাজ করে এবং কেউ যদি চায় তবে কিভাবে গবেষনা শুরু করতে হবে তা ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজকে এই কোষগুলোর গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করে গেছেন বিরামহীনভাবে। তার প্রতিটি সহকর্মী জানেন, স্টাইনম্যান আসলে এই কোষগুলো যে স্বতন্ত্র এক ধরনের কোষ এই ধারনাটা প্রতিষ্ঠা করতে রীতিমত যুদ্ধ করে গেছেন।
শুরুর সেই সময়ে এমনকি তার নিজের ল্যাবের অনেকেই তার দাবীর উপর ভরসা করতে পারেনি যে,স্টাইনম্যান যে কোষের কথা বলছেন এমন কোন কোষের অস্তিত্ব আসলেই আছে,আর স্টাইনম্যানের জন্য প্রধান বাধা ছিলো,এই কোষগুলোর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর মত করে কোন কালচার প্রক্রিয়া তখনও তৈরী করা সম্ভব হয়নি।
আশির দশকে এসে স্টাইনম্যান কিভাবে এই ডেনড্রাইটিক কোষগুলো দিয়ে সরাসরি রোগীদের সাহায্য করা যাবে সেই উপায় খুজতে শুরু করেন। এরপরের কয়েক দশকে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো নিয়ে গবেষনাও বাড়তে থাকে,স্টাইনম্যানের নিজের ল্যাব তখন নজর দিয়েছে ডেনড্রাইটিক কোষ নির্ভর ভ্যাক্সিন (যক্ষা এবং এইচআইভি)এবং ক্যান্সারে চিকিৎসা তৈরীর প্রচেষ্টায়। বেশ কিছু সংক্রামক ব্যাধি যেমন একবার সংক্রমন করলে সারা জীবনের জন্য সেই রোগটি থেকে আমরা সুরক্ষিত থাকি বা আমরা ইমিউনিটি লাভ করি (কৃত্রিম ভাবে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে টিকা যে কাজটি করে),কিন্তু কিছু রোগ আছে,যেমন এইচআইভি,যক্ষা এবং ক্যান্সারগুলো আমাদের জন্য মোকাবেলা করা খুব চ্যালেন্জ্ঞিং একটা ব্যাপার,কারন এরা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাকি দিতে অত্যন্ত দক্ষ। যেমন এইচআইভি র ক্ষেত্রে,ভাইরাসটি এমন কিছু কৌশল বিবর্তিত করেছে,যে এটি ডেনড্রাইটিক কোষগুলোকে হাইজ্যাক করে নেয় নিজের স্বার্থে কাজ করার জন্য;স্টাইনম্যান বলতেন,আমাদেরকে প্রকৃতির থেকে আরো চালাক হতে হবে,অর্থাৎ ডেনড্রাইটিক কোষগুলোকে আমাদের সাহায্য করতে হবে,ভাইরাস এবং টিউমার সম্বন্ধে আরো সুনির্দিষ্ট নিশানা ঠিক করে দেবার মাধ্যমে,যার বিরুদ্ধে আমাদের বিশেষায়িত রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলো যেন আক্রমন করতে পারে।
১৯৯০ এর দশকে মাধব ধোদাপকন (বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে)এবং নীনা ভরদ্বজ এর সাথে (বর্তমানে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে)সাথে যৌথ গবেষনায় স্টাইনম্যান রক্ত থেকে ডেনড্রাইটিক কোষ পৃথক করার প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেন,এবং এই কোষগুলোকে অ্যান্টিজেন (বিভিন্ন জীবানুর,যেমন ইনফ্লুয়েন্জা এবং টিটেনাস,থেকে সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট সুচক প্রোটিনের টুকরো)নিয়ে দিয়ে প্রাইম করা হয়,অর্থাৎ এই কোষগুলোকে পরিচিত করা হয়,এবং তাদের আবার শরীরে প্রবেশ করানো হয় জীবানুগুলোর বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রোস্টেট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রথম ভ্যাক্সিন,প্রোভেন্জ তৈরী করা হয়,যা ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ থেকে ছাড়পত্র পায়,প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের টার্মিনালী বা শেষ পর্যায়ের রোগীদের মধ্যে যার ব্যবহার তাদের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করে বলে ইতিমধ্যেই প্রমানিত হয়েছে-যদিও মাত্র কয়েকমাসের জন্য।
ল্যাবরেটরীতে ক্যান্সার কোষ (মাঝখানে সোনালী রং এর) কে আক্রমন করছে সক্রিয় কিলার টি কোষ ( ছবি: লেনার্ট নিলসন; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে)
ল্যাবরেটরীতে ক্যান্সার কোষ (মাঝখানে সোনালী রং এর) কে আক্রমন করছে সক্রিয় কিলার টি কোষ ( ছবি: লেনার্ট নিলসন; ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক থেকে)
স্টাইনম্যানের কাহিনীর আরো ভিতরে প্রবেশের আগে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো আসলে কি সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করা দরকার।
রোগ প্রতিরোধের দীর্ঘ হাত: ডেনড্রাইটিক কোষগুলো আসলে কি?
আমাদের শরীরের যে অংশগুলো বাইরের পরিবেশের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে, সেখানে কোষগুলোর গভীরে দীর্ঘ সরু শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট টেন্টাকলের মত হাত চারিদিকে ছড়িয়ে অপেক্ষা করে আর পাহারা দেয় ডেনড্রাইটিক কোষগুলো ( Dendritic শব্দটা এসেছে গ্রীক Dendron থেকে যার অর্থ গাছ; রালফ স্টাইনম্যান এই শাখাপ্রশাখা বিশিষ্ট দীর্ঘ সরু কোষের প্রসেস বা হাতগুলো দেখে নাম দিয়ে ছিলেন ডেনড্রাইটিক কোষ); নাকের ভেতরে কিংবা ফুসফুসে, আমাদের অন্ত্রে, এবং বিশেষ করে চামড়ায় এরা গোপনে লুকিয়ে থাকে, যখনই কোন বহিশত্রু আমাদেরকে শরীরকে আক্রমন করার সুযোগ নেবার চেষ্টা করে, এটি সাথেই সাথেই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সতর্ক করে দেয়, চিনিয়ে দেয় শত্রুটাকে, যার বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ করতে হবে। এই ডেনড্রাইটিক কোষগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সবচে কম বুঝতে পারা অথচ অসাধারন দক্ষ সদস্য কোষগুলোর একটি।
গত কয়েক দশকে, বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে কোষটির কিছু রহস্যের সমাধান করেছেন, বিশেষ করে কেমন করে এই ডেনড্রাইটিক কোষগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম কে শেখায়, কোন আমাদের শরীরের অংশ এবং কোনটা আমাদের জন্য বহিশত্রু এবং সম্ভাব্য ক্ষতিকারক। সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় যেটা বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন তা হলো, এই ডেনড্রাইটিক কোষগুলো সার্বিক রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়াটিকে সুচনা এবং নিয়ন্ত্রন করে। যেমন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মেমোরী বা স্মৃতি তৈরীতে এই কোষগুলো খুবই গুরুত্বপুর্ণ, যা আসলে সব ভ্যাক্সিন বা রোগ প্রতিরোধ টিকার কাজ করার মুল ভিত্তি;
রোগ প্রতিরোধে এই কোষটি বিশেষ ভুমিকাটির সুযোগ নেবার চেষ্টা করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এবং বিভিন্ন বায়োটেক কোম্পানী, বিশেষ করে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ভ্যাক্সিন বা টিকা তৈরীর জন্য, এজন্য তারা ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন রোগীদের শরীরের টিউমরটির কিছু অংশ ব্যবহার করে রোগীর নিজস্ব ডেনড্রাইটিক কোষগুলোকে সশস্ত্র করে তোলা, যেন এই কোষগুলোই রোগীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চিনিয়ে দিতে পারে তাদের এই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ডেনড্রাইটক কোষগুলো আরো একটি গুরু দ্বায়িত্ব পালন করে যাকে বলা হয় ইমিউন টলারেন্স ( বা রোগ প্রতিরোধে সহনশীলতা), যার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের রক্ষাকারী কোষগুলো শেখে কিভাবে নিজেদের শরীরের কোষগুলোকে আক্রমন না করতে হয়। এইচআইভি নিয়ে গবেষনার সময় বিজ্ঞানীরা এই কোষটির একটি অন্ধকার দিকও খুজে পান, যেমন অতি চালাক এইচঅআইভি ভাইরাসটি ডেনড্রাইটিক কোষের সাথে যুক্ত হয়ে (অনেকটা হিচ হাইক করে) নিকটবর্তী লসিকা গ্রন্থিতে পৌছে যায় যেখানে এইচআইভি তার মুল শিকার হেলপার টি কোষদের সহজেই আক্রান্ত করে। আবার কখনো কখনো কোষগুলো অসময়ে সক্রিয় হয়ে যায়, ফলে এরা অটোইমিউন কিছু অসুখের কারন হয়ে দাড়ায়; যখন আমাদের শরীরের রোগপ্রতিরোধের কোষগুলো আমাদের শরীরের কোষগুলো শত্রু মনে করে আক্রমন করে বসে।
দুর্লভ এবং মহামুল্যবান:
এই কোষগুলো মুলত একধরনের শ্বেত রক্ত কনিকা। রক্তে মোট শ্বেত রক্ত কনিকাদের মাত্র ০.২ শতাংশ হচ্ছে ডেনড্রাইটিক কোষ, এবং চামড়া বা অন্যান্যে টিস্যু বা কলাতে এর পরিমান আরো কম। ১৮৬৮ সালে একজন জার্মান অ্যানাটোমিষ্ট, পল ল্যাঙ্গারহ্যানস প্রথম চামড়ায় এই কোষগুলো আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু তিনি জানতেন না কোষগুলো সেখানে কি করছে? আবিষ্কারের পর প্রায় ১০০ বছর লেগেছে এদের প্রকৃত কাজটা বুঝতে; বিজ্ঞানীদের নজর এড়ানোর জন্য এদের এই খুব সামান্য পরিমান সংখ্যাই আসলে হয়তো এর প্রধান কারন। ১৯৭৩ সালে মাউসের প্লীহায় রালফ স্টাইনম্যান আবার এদের আবিষ্কার করেন এবং এরা যে রোগ প্রতিরোধের সাথে জড়িত এই বিষয়টি উদঘাটন করেন। তিনি এদের সরু লম্বা শাখাপ্রশাখা যুক্ত হাতের জন্য এদের নাম দেন ডেনড্রাইটিক কোষ। যদিও চামড়ার এপিডার্মিস অংশে যে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো থাকে তারা এখনও ল্যাঙ্গারহ্যানস কোষ বলেই পরিচিত। এই আবিষ্কারটাই আজ প্রস্ফুটিত ডেনড্রাইটিক কোষ বায়োলজীর গবেষনার ভিত্তি রচনা করেছিল।
উপরের ছবিতে মানুষের পুর্ণ বয়স্ক ডেনড্রিইটিক কোষগুলোর সরু সরু কাটার মত অসংখ্য হাত বা কোষ প্রসেস থাকে (১ এবং ২), ইদুরদের (৩ এবং ৪); ইদুরের ডেনড্রিইটিক কোষটি সম্ভবত একটি হেলপার টি কোষের সাথে ইন্টার অ্যাক্ট করছে ছবিতে। এই ধরনের যোগাযোগের মাধ্যমে ডেনড্রিইটিক কোষগুলো রোগ প্রতিরোধ তন্ত্রের কোষগুলোকে শিক্ষিত করে তোলে এটি কিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। ল্যাবরেটরীতে পুর্ণতা প্রাপ্ত কোষগুলোকে ক্যান্সার ভ্যাক্সিনে ব্যবহার করা হয় ( ২)।সুত্র: সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান,নভেম্বর ২০০২ ; The Long Arm of Our Immune System)
এর পরের দুই দশক আসলে কেটেছে, গবেষনার জন্য কিভাবে এই কোষগুলোকে সংখ্যায় কেমন করে বাড়ানো যায়। ফ্রান্সের দার্দিলি তে শেরিং-প্লাউ এর ইমিউনোলজী রিসার্চ ল্যাবের জ্যাক বাঁশোরো ও ( বর্তমানে টেক্সাসে বেইলর ইউনিভার্সিটিতে) তার টীম ১৯৯২ সালে প্রথম সফল হন আমাদের হাড়ের মজ্জার কোষ থেকে ল্যাবরেটরির কালচার ডিশে বহু সংখ্যক ডেনড্রাইটিক কোষ তৈরী করার প্রক্রিয়াটি উদ্ভাবন করতে। প্রায় একই সাথে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়ো ইনাবার সাথে স্টাইনম্যানও সফল হন মাউসের ডেনড্রাইটিক কোষ কালচার করার প্রক্রিয়ায়। ১৯৯৪ সালে আন্তোনিও লানজাভেসচিয়ার টীম ( বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের বেলিনজোনায় ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ ইন বায়োমেডিসিন এ) এবং জেরোল্ড শুলার ( বর্তমানে জার্মানীর ইউনিভার্সিটি অব এরলাঙ্গেন-নুরেমবার্গ এ) খুজে বের করেন কিভাবে মানুষের রক্তের শ্বেত রক্ত কনিকা মনোসাইট থেকে কিভাবে এদের তৈরী করা যায়। বিজ্ঞানীরা এখন জানেন কিভাবে মনোসাইট গুলোকে কিভাবে রাসায়নিক প্রণোদনা দিয়ে ডেনড্রাইটিক কোষে রুপান্তরিত করে রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রন করানো যায় অথবা ম্যাক্রোফেজে পরিনত করা যায় যারা আমাদের শরীরে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, মৃত কোষ এবং জীবানু পরিষ্কার করার কাজ করার জন্য।
ডেনড্রাইটিক কোষকে কালচার করার প্রক্রিয়া জানার পর এদের কাজ সম্বন্ধে গবেষনার পরিধিটা বেড়ে যায় বহুগুনে; এবং বোঝা সম্ভব হয় এই কোষগুলো কাজ করা আসল প্রক্রিয়া। বেশ কয়েক ধরনের ডেনড্রাইটিক কোষ এর সাবসেট আছে, যারা একটি আদি বা প্রিকারসর কোষ থেকে উৎপন্ন হয়ে রক্তে আসে এবং সেখান থেকে অপরিনত ফর্মে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় এটি জায়গা করে নেয় আমাদের চামড়ায়, মিউকাস মেমব্রেন বা পর্দায় এবং বেশ কিছু অঙ্গে যেমন, ফুসফুস, প্লীহা। অপরিণত অবস্থায় ডেনড্রাইটিক কোষগুলির বেশ কিছু কৌশল এবং প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেয় আক্রমনকারী কোন জীবানুকে পাকড়াও করে ধরে ফেলার জন্য। যেমন, এদের আছে সাকশন কাপের মত কিছু রিসেপ্টর (কোষের গায়ে থাকা কিছু সুনির্দিষ্ট কাজে নিয়োজিত অনু) যারা জীবানুকে ধীরে ধীরে টেনে ভিতরে নিয়ে আসে , বা এরা এদের চারপাশে তরল পরিবেশ থেকে আনুবীক্ষনীক পরিমান তরল গিলে ফেলে কোষের ক্ষনস্থায়ী প্রসেস দিয়ে ভিতরে টেনে নেয়; বা একটি ভ্যাকুওল ( কোষ পর্দা দিয়ে ঘেরা একটি ফর্ম) তৈরী করে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসকে ঘিরে ফেলে পুরোপুরি ভিতরে নেবার আগে। টেক্সাস এম ডি অ্যান্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারের গবেষক ইয়ং জুন লিউ দেখেছেন, এই অপরিনত ডেনড্রাইটিক কোষগুলো ইন্টারফেরন আলফা বলে একটা রাসায়নিক পদার্থ নি:সরন করে, ভাইরাসকে সাথে সাথেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
আমাদের শরীরের আক্রমনকারী কোন জীবানু বা আমাদের শরীরের নয় এমন কিছুকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেবার পর এরা সেগুলোকে এনজাইম দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে ফেলে; এদের মধ্যে সেই টুকরা(গুলো)কেই বেছে নেয় কোষটি, যা এই জীবানুটিকে চেনার জন্য এবং যার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত (সাধারণত কতগুলো অ্যামাইনো অ্যাসিডের অনুক্রম বা পলিপেপটাইড), এদের বলা হয় অ্যান্টিজেন। ডেনড্রাইটিক কোষ পিচ ফর্কের মত একটি অনু ব্যবহার করে এই টুকরো অংশ বা অ্যান্টিজেনটিকে তাদের কোষের বাইরে পৃষ্ঠে প্রদর্শন করার জন্য। এই পিচ ফর্কের মত অনুগুলোর নাম মেজর হিস্টোকমপ্যাটিবিলিটি কমপ্লেক্স (Major Histocompatibilty Complex বা সংক্ষেপে MHC); এরা সাধারনত: দুই ধরনের হয় ক্লাস ১ এবং ক্লাস ২; এদের দুটোর আকৃতিই ভিন্ন। এই এমএইচসি অনুর মধ্যেই তারা বহন করে অ্যান্টিজেনটিকে। ডেনড্রাইটিক কোষগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে এরা খুবই দক্ষ এমনকি সামান্যতম মাত্রার কোন অ্যান্টিজেনকে ধরে প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে।
উপরের ছবিতে ডেনড্রাইটিক কোষ কোন জীবানু সংক্রমনের বিরুদ্ধে কিভাবে কাজ করে তার একটি স্কীমাটিক ডায়াগ্রাম। (ছবিটি বড় করে দেখুন);(সুত্র: সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান,নভেম্বর ২০০২ (ইলাসট্রেশন: Terese WINSLOW in The Long Arm of Our Immune System)
অ্যান্টিজেন প্রক্রিয়াজাত করার সময়ই এরা তাদের তাদের যাত্রা শুরু করে লসিকা নালীর মধ্যে লসিকা বা লিম্ফ এর মধ্য দিয়ে, আক্রান্ত কলা বা টিস্যু থেকে এরা বের হয়ে আসে নিকটবর্তী লসিকা গ্রন্হিতে, যেটা অনেক সেনানিবাসের মত, টি এবং বি লিম্ফোসাইট উর্বর একটি জায়গা। ডেনড্রিইটিক কোষগুলো এই যাত্রা পথেই পুর্নতা লাভ করে; এই গন্তব্যে পৌছানোর পর এমএইচসি অনুর মাধ্যমে কোষগুলো একেবারে নবীন হেলপার বা সাহায্যকারী টি কোষ বা লিম্ফোসাইটের (CD4+কোষ) -যারা এর আগে কোন অ্যান্টিজেন এর মুখোমুখি হয়নি-কাছে উপস্থাপন করে। এই ডেনড্রাইটিক কোষগুলোই একমাত্র কোষ যা নবীন হেলপার টি কোষ গুলোকে অ্যান্টিজেন চেনাতে পারে: কোনটা আমাদের শরীরের অংশ না এবং ক্ষতিকর এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই অনন্য ক্ষমতার কারন এদের একটি সহ রিসেপ্টর থাকে, যে সহ রিসেপ্টরটি এই কোষের সাথে হেলপার টি কোষের আরেকটি সম্পর্কযুক্ত রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হলে এই প্রশিক্ষনের কাজটি প্রকৃতপক্ষে ঘটে থাকে বেশ কিছু ধারাবাহিক রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়।
প্রশিক্ষন শেষ হবার পর সাহায্যকারী টি কোষগুলো (এদের সাহায্য বলার কারন এরা অন্যান্য বিশেষায়িত কোষগুলোকে সক্রিয় হবার জন্য সাহায্য করে), বি কোষকে সক্রিয় করে, অ্যান্টিবডি ( এরা এক ধরনের রাসায়নিক অনু যা একটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন এর সাথে যুক্ত হতে পারে) তৈরী করার জন্য। যে অ্যান্টিবডি গুলো অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে অ্যান্টিজেন বাহী কোষ বা জীবানুকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে বা এদের চিনিয়ে দিতে সাহায্য করে অন্য কিছু কোষকে, যেমন ম্যাক্রোফেজ। ডেনড্রাইটিক কোষ এবং হেলপার টি কোষ, কিলার টি কোষকেও (কিলার বলার কারন এরা সরাসরি আক্রমন করে কোষ পর্দায় ছিদ্র করে কোষকে হত্যা করতে পারে) সক্রিয় করে, যা এই অ্যান্টিজেনবাহী কোন জীবানু আক্রান্ত কোষকে সরাসরি আক্রমন করে, তাদের বিস্তার রোধ করতে।
ডেনড্রাইটিক কোষের প্রশিক্ষন পাওয়া কিছু কোষ, ’মেমোরী’ কোষ হিসাবে আমাদের শরীরে রয়ে যায় বহু বছর, যারা ভবিষ্যতে কোন আক্রমনের সময় দ্রুত এর প্রতিরোধে সক্রিয় হয়। রোগ প্রতিরোধে কোন কোষগুলো প্রধান ভুমিকা রাখবে তা নির্ভর করবে ডেনড্রাইটিক কোষদের কোন সাবসেট এখানে সক্রিয় হচ্ছে এবং টি কোষের সাথে যুক্ত হবার সময় এটি টি কোষকে কোন টাইপের সাইটোকাইন নি:সরণ করতে প্রণোদনা দিচ্ছে। পরজীবি এবং কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে যেমন টাইপ ২ সাইটোকাইন গুলো বি কোষগুলোকে অ্যান্টিবডি তৈরীতে বেশী সক্রিয় করে তোলে। আবার টাইপ ১ সাইকোকাইনগুলো যেমন কিলার টি কোষগুলোকে বেশী সক্রিয় করে তোলে যখন ভাইরাস এবং অন্তকোষী ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত কোষকে আক্রমন করার প্রয়োজন হয়। যদি ডেনড্রাইটিক কোষ ভুল করে ভুল সাইটোকাইন তৈরী করার প্রণোদনা দেয়, আমাদের রোগপ্রতিরোধ কারী কোষগুলোও ভুল প্রতিক্রিয়া দেখায়। প্রয়োজনীয় এবং যেমনটা দরকার সেরকম রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া জীবন মরনের ব্যপার হতে পারে। যেমন কুষ্ট বা লেপরোসী রোগ, এর কারন যে ব্যাকটেরিয়াটি, তার দ্বারা আক্রান্ত কোন রোগী যদি টাইপ ১ প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাদের অসুখটা কম মাত্রার টিউবারকুলয়েড ধরনের কুষ্ঠ হয়, তবে যদি টাইপ ২ প্রতিক্রিয়া হয়ে তবে ভয়ঙ্কর লেপরোম্যাটাস ধরনের কুষ্ঠ রোগ হয়।
ক্যান্সার হত্যাকারী:
নবীন হেলপার টি কোষগুলো, যারা কোন অ্যান্টিজেনের মুখোমুখি হয়নি, তাদের সক্রিয় করাই ব্যবহৃত হয় এমন প্রায় সব ভ্যাক্সিনেরই মুল কার্য্যপ্রণালী। জীবানু এবং তাদের তৈরী টক্সিন বা বিষের প্রতিরোধে ডেনড্রাইটিক কোষ যে দ্বায়িত্ব পালন করে, বিজ্ঞানীরা এখন সেই কৌশলটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন, ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কৌশল হিসাবে। ক্যান্সার কোষগুলো মুলত: শরীরের জন্য অস্বাভাবিক; স্বাভাবিক কোষ যে অনুগুলো তৈরী করে না, ক্যান্সার কোষ সেগুলো তৈরী করতে পারে। যদি বিজ্ঞানী এমন কোন ঔষধ বা ভ্যাক্সিন তৈরী করতে পারে, যা শুধু সেই অস্বাভাবিক অনুগুলোকে নিশানা হিসাবে ব্যবহার করবে,তাহলে তারা আরো ভালোভাবে ক্যান্সার কোষকে ধ্বংশ করতে করার সুযোগ পাবে, আশে পাশের নিরীহ স্বাভাবিক কোষগুলোকে অক্ষত রেখে। আর এটা সম্ভব হলে রোগীরা কেমোথেরাপী বা রেডিয়েশনের ভয়ঙ্কর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাবেন।
কাজটা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন শুধুমাত্র ক্যানসার কোষেই দেখা যায় এমন অ্যান্টিজেন আসলেই দুষ্প্রাপ্র; তারপরও কিছু খুজে পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চামড়ার ক্যান্সার মেলানোমা ( মেলানোসাইটদের একটি ক্যান্সার, মেলানোসাইটগুলো আমাদের চামড়ার রঙের জন্য দায়ী, চামড়ায় দেখা তিল গুলো আসলে মেলানোসাইটদের ছোট একধরনের নীরিহ টিউমার)। ১৯৯০ এর শেষে ব্রাসেলস এর লুডভিগ ক্যান্সার ইন্সস্টিস্টিউটের থিয়েরী বুন এবং ন্যাশনাল ক্যানসার ইন্সস্টিস্টিউটে স্টিভেন রোজেনবার্গ ও তাদের সহকর্মীরা স্বতন্ত্রভাবে মেলানোমা নির্দিষ্ট অ্যান্টিজেন খুজে পান, যা এখন বেশ কয়েকটি ট্রায়ালে আছে এমন ভ্যাক্সিনের টার্গেট।
মানুষের উপর এ ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে সাধারনত যে ভ্যাক্সিন ব্যবহার করা হয়, তাদের তৈরী করা হয় ডেনড্রাইটিক কোষের প্রিকারসর ( অর্থাৎ যে কোষ থেকেই ডেনড্রাইটিক কোষ সৃষ্টি হয়) কোষ দিয়ে যা রোগীদের শরীর থেকে আলাদা করে সংগ্রহ করা হয়। এবং ল্যাবে টিউমরের অ্যান্টিজেন এর সাথে কালচার বা চাষ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ডেনড্রাইটিক কোষগুলো টিউমরের অ্যান্টিজেনগুলো তাদের কোষে ভিতর ঢুকিয়ে নেয়, এবং সেগুলো প্রক্রিয়াজাত করে তাদের কোষের পর্দার উপর এমএইচসি অনুর সাহায্যে প্রকাশ করে। গবেষকরা এই কোষগুলোকে আবার রোগীর শরীরে ফিরিয়ে দেন, যেন টিউমরের অ্যান্টিজেন সহ এই ডেনড্রাইটিক কোষগুলো রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোকে সেই বিশেষ টিউমরের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষিত করে তোলে। এবং রোগ প্রতিরোধ কারী কোষগুলো টিউমারের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করে।
অনেকগুলো টীমই এই অ্যাপ্রোচে এখন গবেষনা করছে, নানা ধরনের ক্যানসারের বিরুদ্ধে ; যেমন মেলানোমা, বি সেল লিম্ফোমা, প্রোষ্টেট এবং কোলন ক্যান্সার ইত্যাদি। কিছু সাফল্যর দেখাও মিলেছে, জ্যাক বাঁশোরোর টীম এবং স্টাইনম্যানের টীম ১৮ জনের মধ্যে ১৬ জন অগ্রবর্তী পর্যায়ের মেলানোমা রোগীদের,যাদের মেলানোমা অ্যান্টিজেন সহ ডেনড্রাইটিক কোষ ভ্যাক্সিন দেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে দেখেছেন, টিউমারটির প্রতি এই ভ্যাক্সিনটি রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও ৯ জন রোগীর টিউমারের আকৃতি বৃদ্ধি হারও কমে গেছে, যারা এর দুটি অ্যান্টিজেনের প্রতি রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলতে পেরেছে ভ্যাক্সিনের কারনে। বিজ্ঞানী গত একদশক ধরে এই প্রক্রিয়াকে আরো কার্যকরী এবং অরো বেশী সংখ্যক রোগীর উপর গবেষনা করার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত।
উপরের ছবিতে স্তনের ক্যান্সার টিস্যুতে বিশেষ উপারে রন্জ্ঞিত করা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ডেনড্রিইটিক কোষগুলোকে দেখা যাচ্ছে (১); বা লাল ( চামড়ায়) (২) ; কোষগুলো যখন পুর্ণতা পায়, তারা একধরনের প্রোটিন তৈরী করে, যা তাদের একটার সাথে আরেকটা যুক্ত হয়ে থাকতে সহায়তা করে (৩); তারা কাটা চামচের মত দেখতে কিছু রিসেপ্টরও তৈরী করে তাদের গায়ে, যা আক্রমন কারী কোন জীবানুর কোন টুকরা অংশ বহন করে রোগ প্রতিরোধ কারী অন্যান্য কোষগুলোকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য( ৪ নং ছবিতে সবুজ ডটগুলো)। সুত্র: সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান,নভেম্বর ২০০২ ; The Long Arm of Our Immune System)
এখন পর্যন্ত ডেনড্রাইটিক কোষ ভ্যাক্সিন পরীক্ষা করা হয়েছে ক্যানসারে সর্বশেষ পর্যায়ে আক্রান্ত রোগীদের উপর, যদিও গবেষকরা বিশ্বাস করেন এই ভ্যাক্সিনগুলো আরো ভালো কাজ করবে যদি ক্যানসারের প্রথম পর্যায়ে দেয়া হয়, কারন সর্বশেষ পর্যায়ের রোগীদের মতন তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনো টিউমারটি অপসারন করার চেষ্টা করেনি এবং ব্যর্থও হয়নি।
কিন্তু কিছু সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা প্রথমে ভাবতে হবে, এ ধরনের ডেনড্রাইটিক কোষ নির্ভর ভ্যাক্সিন হয়তো বা রোগী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে তার কিছু সুস্থ কোষকেও আক্রমন করার জন্য প্ররোচিত করতে পারে অ্যান্টিজেনের সাদৃশ্যতার জন্য, যেমন, শ্বেতী বা ভিটিলিগো – চামড়া সাদা হয়ে যাওয়া জায়গাগুলো, যা স্বাভাবিক চামড়ার রন্জ্ঞক পদার্থ র্ন কোষ মেলানোসাইট ধ্বংস হবার কারনে হয়ে থাকে –মেলানোমা ক্যানসারের রোগীরা যারা অ্যান্টি মেলানোমা ক্যানসার ভ্যাক্সিন এর সবচে পুরোনো সংস্করনটি যারা পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি হয়েছিল, কিন্তু বড় কোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি ( প্রায় ১০০০ রোগীকে এই ভ্যাক্সিনটি দেয়া হয়েছিল); আবার এমনও হতে পারে ক্যান্সার নিজেই মিউটেশনের মাধ্যমে তার অ্যান্টিজেন বদলাতে পারে, ডেনড্রাইটিক কোষের প্রশিক্ষন পাওয়া রোগ প্রতিরোধী কোষের আক্রমন থেকে ’পালাতে’; এমনও হতে পারে টিউমার কোষগুলো সেই অ্যান্টিজেনটি ( যে অ্যান্টিজেন দিয়ে ভ্যাক্সিনটি ডিজাইন করা হয়েছে) তা আর তৈরীই করলো না। এই সমস্যা অবশ্য শুধুমাত্র ডেনড্রাইটিক কোষ নির্ভর ভ্যাক্সিন এরই না, প্রচলিত ক্যান্সার চিকিৎসারও।
তাছাড়া খরচের ব্যাপারটাও আছে, শুধু একটা রোগীর টিউমার নির্ভর চিকিৎসা তৈরী করাটা ব্যয় সাপেক্ষ একটা ব্যপার। কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী রোগীদের শরীর থেকে ডেনড্রাইটিক কোষ আলাদা করে তাদের ল্যাবে প্রক্রিয়াজাত করে আবার রোগীর শরীরে ইনজেকশান দেয়া এই প্রক্রিয়ার বেশী খরচ এবং সময়ের বিষয়টাকে এড়ানোর জন্য চেষ্টাও করে যাচ্ছেন। একটা উপায় হলো, রোগীর শরীরে ইতিমধ্যেই থাকা ডেনড্রাইটিক কোষ এর প্রিকারসর বা আদি কোষগুলোকে সংখ্যায় বাড়ানো এবং টিউমারের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য এদের ডেনড্রাইটিক কোষের রুপান্তরিত হবার প্ররোচনা দেয়া। ডেভিড এইচ লিন্চ এবং তার টীম ( বর্তমানে বেইনব্রিজ বায়োফার্মা কনসাল্টিং, ওয়াশিংটন এ) একটি বিশেষ সাইটোকাইন আবিষ্কার করেছেন, যা ঠিক এই কাজটি করে মাউসদের মধ্যে। এছাড়া জন হপকিন্স এর ড্রিউ এম পারডল তার গবেষনায় দেখিয়েছেন, ডেনড্রাইটিক কোষকে প্ররোচিত করতে যদি টিউমার কোষকিই জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বেশী বেশী করে সাইটোকাইন নিঃসরনে বাধ্য করা হয় সেটাইসম্ভবত সবচেয়ে কার্য্যকর অ্যাপ্রোচ হবে ক্যানসারের বিরুদ্ধে ভ্যাক্সিন তৈরী করার ক্ষেত্রে।
আরেকটি অ্যাপ্রোচ, যা রকফেলারে স্টাইনম্যান ও তার সহকর্মী মিশেল সি নুসেনজোয়াইগ শুরু করেছিলেন,তা হলো অ্যান্টিজেনকে সুনির্দিষ্টভাবে নিশানা করার জন্যেএর সাথে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি জুড়ে দেয়া, যা ডেনড্রাইটিক কোষের উপরে থাকা একটি নির্দিষ্ট অনুর সাথে যুক্ত হবে। এই অনুগুলোর এমন বৈশিষ্ট থাকতে হবে যে অ্যান্টিজেন সহ যখনই অ্যান্টিবডি যখনই এই অনুর সাথে যুক্ত হবে, এটি ডেনড্রাইটিক কোষকে প্ররোচিত করবে একে কোষের ভিতর নিয়ে যেতে, এটি ভিতরে যাবার পর অ্যান্টিজেনটি পুনরায় কোষের ভিতর প্রক্রিয়াজাত হয়ে এমএইচসি ১ এবং এমএইচসি ২ এর সাথে একে প্রদর্শন করবে। এ ধরনের বেশ কয়েকটি অনু নিয়ে বিজ্ঞানী আরো জোরদার গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মাউসদের মধ্যে গবেষনা বলছে যে, যদি ডেনড্রাইটিক কোষকে সক্রিয় না করেই অ্যান্টিজেনকে নিশানা বানানো হয় তাহলে টলারেন্স তৈরী হয় ( সহনশীলতা, যা প্রতিরোধ করেনা); কিন্তু অ্যান্টিজেনকে ডেনড্রাইটিক কোষের সক্রিয়কারীদের সাথে একসাথে ব্যবহার করলে প্রতিরক্ষা উপোযোগী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়া:
আরেকদল বিজ্ঞানী চেষ্টা করছেন ডেনড্রাইটিক কোষকে থামিয়ে দিতে তার কাজে বাধা দিয়ে, যেখানে তাদের অতি সক্রিয়তা প্রতিরোধ করার বদলে অসুখের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সাধারনত আমদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় একটা প্রক্রিয়া ঘটে, যাকে বলে সেন্ট্রাল টলারেন্স (বা কেন্দ্রীয় সহনশীলতা); এটা ঘটে আমাদের বুকের মধ্যে থাকা একটি অঙ্গে ( যা সময়ের সাথে বিলুপ্ত হয়ে যায়) যার নাম থাইমাস (থাইমাসে পুর্ণতা পায় বলে একধরনের লিম্ফোসাইট ( শ্বেত রক্ত কনিকা) বলে টি লিম্ফোসাইট বা টি কোষ); থাইমাস, আমাদের শরীরের যে টি কোষগুলো, আমাদের শরীরেরই কোন অংশকে, আমাদের অংশ নয় বলে চেনে, এই সব ক্ষতিকর আত্মঘাতী টি কোষকে রক্তে আসার আগে শরীর থেকে সরিয়ে ফেলে। কিন্তু কিছু এধরনের ক্ষতিকর টি কোষ অবশ্যই থাইমাসের নজরদাড়ি এড়িয়ে যায়, সুতরাং এই সমস্যার একটা বিহিত করতে আমাদের শরীরেরও একটি ব্যাক আপ ব্যবস্থা করেছে: এই সব টি কোষকে যে প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীর নিয়ন্ত্রন করে তার নাম পেরিফেরাল (কেন্দ্রর বাইরে) টলারেন্স বা সহনশীলতা।
কিছু রোগী, যাদের অটোইমিউন রোগ আছে ( নিজের শরীরের কোন উপাদানের উপর নিজের রোগপ্রতিরোধ কারী কোষগুলো যখন ভিন্ন ভেবে চড়াও হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করে শরীরকে), যেমন, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, টাইপ ১ ডায়াবেটিস, সিস্টেমিক লুপাস ইত্যাদি; তাদের এই পেরিফেরাল টলেরান্সের মেকানিজমে কিছু সমস্যা থাকে। ২০০১ সালে জাক বাঁশোরো ও তার সহযোগীরা দেখান যে, সিস্টেমিক লুপাস এর রোগীদের ডেনড্রাইটিক কোষ অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় এবং এই কোষগুলো বেশী মাত্রায় ইন্টারফেরোন আলফা নিঃসরণ করে। যে প্রোটিনটি আদি কোষ থেকে পুর্ন বয়স্ক ডেনড্রাইটিক কোষের রুপান্তর বাড়িয়ে দেয় রক্তে থাকা অবস্থায়। এই পুর্ন বয়স্ক ডেনড্রাইটিক কোষ তখন রক্তে থাকা রোগীর ডিএনএ কে কোষের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় ( লুপাসের রোগীদের রক্তে এমনিতেই স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক বেশী ডিএনএ অনু রক্তে থাকে) এবং এটিকে অ্যান্টিজেন হিসাবে প্রদর্শন করে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো রোগীর নিজের ডিএনএর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে প্ররোচনা দেয়, এই অ্যান্টিবডি শরীরের নানা অংশে প্রতিক্রিয়া করে জটিল রোগের সৃষ্টি করে। এখানে ডেনড্রাইটিক কোষ এর অতিসক্রিয়তা এবং ইন্টারফেরোন আলফা নিঃসরণ বন্ধ করলে এই ঘাতক রোগের একটি চিকিৎসা আবিষ্কার করা সম্ভব। একই ভাবে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের রোগীদের ক্ষেত্রে এই কোষগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে, নতুন অঙ্গ বাতিল করার শারীরিক ইমিউন প্রক্রিয়াকেও নিয়ন্ত্রন করা যেতে পারে।
এমনকি এইডস এর নতুন চিকিৎসার জন্য ডেনড্রাইটিক কোষ সম্বন্ধে আরো জানা প্রয়োজন। ২০০০ সালে নেদারল্যান্ডস এর নিমেজেন এর সেইন্ট রাডবুড মেডিকেল সেন্টারে কার্ল জি ফিগডর এবং ইভেট ভ্যান কুইক, একটি বিশেষ গ্রুপ ডেনড্রাইটিক কোষ খুজে পান যারা DC-SIGN (Dendritic Cell-Specific Intercellular adhesion molecule-3-Grabbing Non-integrin) বলে একটি অনু তৈরী করে, যে অনুটা এইচ আই ভি ভাইরাসের বাইরের পর্দার একটি অনুর সাথে সংযুক্ত হতে পারে। এই কোষগুলো মিউকাস মেমব্রেনে পাহারা দেবার সময় ভাইরাসটি এই অনুর সাথে ডেনড্রাইটিক কোষের অজান্তেই নিজেকে যুক্ত করে ফেলে, এবং এরা যখন লসিকা গ্রন্থিতে আসে এইচ আই ভি অসংখ্য টি কোষ পায় আক্রমন করার জন্য। যে ঔষধটি এই DC-SIGN এর সাথে HIV ভাইরাসের এই যুক্ত হবার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারে, সেটি AIDS হবার সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। এছাড়া অনেক সংক্রামক ব্যাধির জীবানু যেমন ম্যালারিয়া, মিজলস (হাম) এবং সাইটোমেগালোভাইরাস – এরাও ডেনড্রাইটিক কোষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। যেমন ম্যালেরিয়া পরজীবি দ্বারা আক্রান্ত লোহিত রক্ত কনিকা গুলো ডেনড্রাইটিক কোষগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে এদের পুর্নতা পেতে দেয়না, ফলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এরা ম্যালেরিয়ার জীবানুর বিরুদ্ধে সতর্ক করতে বাধার মুখে পড়ে। বেশ কয়েকটি গ্রুপের গবেষকরা চেষ্টা করছেন ডেনড্রাইটিক কোষগুলোকে এধরনের হাইজ্যাকিং থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তার জন্য।
এই কোষটিকে নিয়ন্ত্রন কারী অনুগুলো সম্বন্ধে আমরা যত জানবো ততই আমরা চিকিৎসার জন্য এই কোষটিকে ব্যবহার করা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবো। ক্রমশ বাড়তে থাকা গবেষকদের সংখ্যা এবং ফার্মাসিউটিক্যাল কর্পোরেশনদের এই কোষ নিয়ে কাজ করার জন্য আগ্রহ বৃদ্ধি আভাস দিচ্ছে, খুব শিঘ্রই আমরা এই কোষগুলোর সর্ব্বোচচ ক্ষমতাগুলো আমরা আমাদের আক্রান্ত করা নানা রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে কাজে লাগাতে সক্ষম হবো।
এবার ফিরে যাই মুল লেখায়।
শেষ বড় এক্সপেরিমেন্ট, একজন বিজ্ঞানী যখন রোগী:
২০০৭ এর প্রথম দিকে কলোরাডোতে একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দেবার সময় স্টাইনম্যান হঠাৎ করে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েনএবং মার্চের শেষ সপ্তাহে তার অগ্নাশয়ে টিউমারটি ধরা পড়ে সিটি স্ক্যানে। ততদিনে এটি ছড়িয়ে পড়েছে কাছাকাছি লসিকা গ্রন্হিগুলোতে। স্টাইনম্যান জানতেন তার বেচে থাকার সম্ভাবনা কত ক্ষীন। অগ্নাশয়ের এই ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৮০ শতাংশই মারা যায় প্রথম বছরেই। মেয়ে আলেক্সিস এর মনে আছে,স্টাইনম্যান যখন তার অসুখ নিয়ে পরিবারে সবার সাথে কথা বলেছিলেন,তার আত্মবিশ্বাস ছিল স্পষ্ট, কারন অসুখটা যদিও ভয়াবহ,তবে পৃথিবীর যে কোন ক্যান্সারের রোগীর তুলনায় তার অবস্থান কিন্তু ছিল ভিন্ন:পৃথিবীর সেরা ইমিউনোলজিষ্ট আর ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা তার সহকর্মী; কিন্তু তারচেয়েও গুরুত্বপুর্ন,স্টাইনম্যান জানতেন,তার এই সহকর্মী গবেষকরা ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য প্রতিশ্রুতিশীল বেশ কিছু চিকিৎসা নিয়ে গবেষনা করছেন,যার অনেকগুলোই তার পথ দেখানো ডেনড্রাইটিক কোষ নির্ভর।
সহকর্মীদের মধ্যে প্রথম খবরটি পান সারাহ স্লেশিঙ্গার;হাই স্কুলে পড়ার সময় সারাহ, জানভিল কোন এর ল্যাবে কাজ করতে এসেছিলেন একটা সামার প্রোগ্রামে,সেখান থেকেই তার পরিচয় স্টাইনম্যানের সাথে। একই বেন্চে বসে স্টাইনম্যান তাকেও ডেনড্রাইটিক কোষ খোজার নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। স্লেশিঙ্গার এবং আরেক ঘনিষ্ট সহকর্মী মিশেল নুসেনজোয়াইগ সাথে নিয়ে স্টাইনম্যান ধীরে ধীরে তার বিশাল নেটওয়ার্কের সবাইকে খবরটা ফোন করে জানান।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন,তার আরো একটি এবং হয়তো বা তার জীবনে শেষ পরীক্ষাটি এবার তাকে করতে হবে।স্টাইনম্যান দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন,কোন ক্যান্সারকে নিশ্চিতভাবে চিকিৎসা করতে হলে রোগীর নিজের ডেনড্রাইটিক কোষগুলো এই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরী করতে হবে। তার এই ধারনা সঠিক প্রমান করার জন্য যে পরীক্ষার কথা ভাবছিলেন স্টাইনম্যান,তার জন্য তাদের হাতে সময়ও ছিল না খুব একটা বেশী ।
স্টাইনম্যানের এর পরের ফোনটি ছিল তার দীর্ঘদিনের সহযোগী এবং বর্তমানে ডালাসে বেইলর ইন্সস্টিটিউট ফর ইমিউনলজীর পরিচালক জাক বাঁশোরো কে। বাশোরো যোগাযোগ করেন বেইলর এর গবেষক এবং স্টাইনম্যানের ল্যাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা আনা ক্যারোলীনা পালুকার সাথে; যিনি এই রকম একটি পরীক্ষা মুলক ভ্যাক্সিন নিয়ে তখন গবেষনা করছিলেন। পালুকার মনে হয়েছিল,তার ভ্যাক্সিনটি হয়তো স্টাইনম্যানকে সাহায্য করতে পারে,কিন্তু তার ব্যক্তিগত চ্যালেন্জ্ঞটি ছিল,বন্ধু, রোগী এবং বিজ্ঞানী স্টাইনম্যানকে পৃথক করা।
সহকর্মী স্লেশিঙ্গার যোগাযোগ করলেন স্টাইনম্যানের আরেকজন দীর্ঘদিনের সহযোগী এবং আরএনএ বেসড ড্রাগ কোম্পানী আরগোস থেরাপিউটিকস(এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্টাইনম্যান)এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা চার্লস নিকোলেটকে;নিকোলেট এর টীম ইতিমধ্যে একটি ডেনড্রাইটিক কোষ ভ্যাক্সিন তৈরী করেছিল,যা একটি ট্রায়ালে ছিল (ফেজ ২)কিডনীর কান্সার রোগীদের চিকিৎসার জন্য।আরগোস এই টীমটি প্রথমে রোগীর শরীরে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো সংগ্রহে নিয়ে তাদেরকে টিউমর থেকে নেয়া জেনেটিক উপাদানের কিছু নির্দিষ্ট জীন যা টিউমারটির এন্টিজেনিসিটি নির্ধারন করে,সেটি দ্বারা ট্রান্সফেকশন (জীনটি ডেনড্রাইটিক কোষের ভিতরে ঢুকে পরে)করানো হয় ডেনড্রাইটিক কোষের ভিতরে,এবং প্রয়োজনীয় অ্যান্টিজেন প্রোটিনটি কোষের ভিতর তৈরী হলে ডেনড্রাইটিক কোষগুলো তা পক্রিয়াজাত করে,টি কোষের কাছে উপস্থাপন করে,ফলে রোগীর শরীরে এটা টিউমর বিরোধী শক্তিশালী একটি প্রতিক্রিয়ার সুচনা করে।
২০০৭ সালে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে স্টাইনম্যানের প্যানক্রিয়াসের কিছু অংশ কেটে ফেলে দেয়া হয়, নিকোলেটের সেই কেটে ফেলা টিউমারের কিছু অংশ দরকার ছিল তার ভ্যাক্সিন তৈরীর কাজ শুরু করার জন্য। স্টাইনম্যানকে এই ভ্যাক্সিনের ট্রায়ালে যোগ দেবার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এবং ড্রাগ অ্যাডমিনিষ্ট্রেশনের বিশেষ অনুমতি নিতে হয়,নিকোলেট এর টীমকে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এই অনুমতি জোগাড় করতে হয়। স্টাইনম্যানের টিউমার কোষ পাবার পর এবং আরগোসের ভ্যাক্সিন তৈরী কাজ শেষ হতে, সময় তখন লাগবে বেশ কয়েকমাস। এই সময়টাতে স্টাইনম্যান অন্য চিকিৎসা, প্রচলিত জেমসাইটিবিন-নির্ভর কেমোথেরাপী নিতে শুরু করেন।
২০০৭ এর গ্রীষ্মের শেষ দিকে তিনি যোগ দেন GVAX ট্রায়ালে;এই ভ্যাক্সিনটি যৌথভাবে তৈরী করেছিলেন জন হপকিন্স এর এলিজাবেথ জাফে, হার্ভার্ড এর একটি টীমের সাথে, এটির নিশানা ছিল প্যানক্রিয়াস এর ক্যান্সার,তবে টার্মিনালী প্রোস্টেটের ক্যান্সারের জন্য ছাড়পত্র পাওয়া প্রোভেন্জ যেমন, এটাও তেমনি কোন নির্দিষ্ট না বরং একটি সার্বজনীন টিউমার অ্যান্টিজেন ব্যবহার করে তৈরী করা।এর আগের একটি ফেজ ২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যারা এই ভ্যাক্সিনটি পাচ্ছে তারা, যারা পাচ্ছেনা তাদের থেকে বেশ কয়েক মাস বেশী দীর্ঘ আয়ু লাভ করে। দুই মাস ধরে স্টাইনম্যান হার্ভার্ড ক্যান্সার সেন্টারে GVAX এর চিকিৎসা পান।
সবার মনেই তখন শঙ্কা স্টাইনম্যান কি আগামী শরৎটা দেখে যেতে পারবেন কিনা।
সবার শঙ্কা দুর করে মোটামুটি ভালোই থাকলেন স্টাইনম্যান। ২০০৭ এর সেপ্টেম্বরে লাসকার পুরষ্কারে পেলেন। একের পর এক টিভি ইন্টারভিউ আর ভিডিও কনফারেন্সে তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে ডেনড্রাইটিক কোষের অপার সম্ভাবনার কথা বললেন:ডেনড্রিইটিক কোষ নির্ভর চিকিৎসা ক্যানসারে প্রচলিত চিকিৎসার চেয়ে অনেক বেশী সুনির্দিষ্ট এবং অনেক কম ক্ষতিকর পার্শপ্রতিক্রিয়াহীন।কিন্তু আরো গবেষনা এবং ধৈর্যর প্রয়োজন, এর মুলনীতিগুলো বোঝার জন্য।
ছবি: স্টাইনম্যানের ডেনড্রাইটিক কোষ নির্ভর ভ্যাক্সিনের একটি স্কীমাটিক ডায়াগ্রাম ( ছবিটি বড় করে দেখুন)
এসময় তার সহকর্মীদের তুলনায় স্টাইনম্যানই বেশী ধৈর্য্যর প্রমান দিয়েছেন। তিনি তার সহকর্মীদের সাথে প্রথমে যুক্তি দিয়েছিলেন, যে GVAX তিনি ধীরে ধীরে নেবেন এবং প্রতিটি থেরাপীর মধ্যে তার রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কতটুকু বাড়লো এটা তিনি পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পাবেন। কিন্তু তার সহকর্মীরা তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন,সেটা করার জন্য তাদের হাতে বেশী সময় নেই। কারন তিনি যদি বেচে না থাকেন তাহলে এই পরীক্ষা বা উপাত্ত সংগ্রহ কোনটাই হবেনা।
নভেম্বর ২০০৭ সালে কেমোথেরাপী শেষে স্টাইনম্যান আরগোস এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যোগ দিলেন একক রোগীর স্বতন্ত্র একটি প্রোটোকলে। তার নিজের টিউমার কোষের জেনেটিক উপাদান নিয়ে স্টাইনম্যানের ডেনড্রাইটিক কোষগুলোকে প্রস্তুত করার পর আবার স্টাইনম্যানের শরীরে প্রবেশ করানো হলো। এরপর ২০০৮ এর শরতে পালুকার ভ্যাক্সিনটি তিনি গ্রহন করেন (যেটির মুল নিশানা ছিল মেলানোমা,চামড়ায় হওয়া একধরনের কান্সার); পালুকা তার মেলানোমার জন্য তৈরী করা একটি ডেনড্রাইটিক কোষ ভ্যাক্সিন এর খানিকটা পরিবর্তন করে স্টাইনম্যানের টিউমরের একটি প্রোটিন টুকরা ব্যবহার করে এই কোষগুলোকে নতুন করে প্রোগ্রাম করলেন শুধু স্টাইনম্যানের জন্য।
সারা পৃথিবী জুড়ে স্টাইনম্যানের সহযোগী যারাই এক্সপেরিমেন্টাল চিকিৎসা নিয়ে কাজ করছিলেন, সবাই স্টাইনম্যানকে তাদের চিকিৎসা নেবার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। স্টাইনম্যান কয়েক দশক ধরে বিশাল সহযোগী বিজ্ঞানীদের এক বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরী করেছিলেন, তারা সবাই স্টাইনম্যান এর পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন। ক্যানসারের প্রচলিত চিকিৎসা ছাড়াও বিশেষ রোগীর শ্রেনীবিভাগে মোট চারটি ভিন্ন ভিন্ন ড্রেনড্রাইটিক কোষ নির্ভর ক্যান্সার চিকিৎসার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যোগ দেন স্টাইনম্যান, যাদের কোনটাই এর আগে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারে ব্যাবহার করা হয়নি, এছাড়াও আরো কিছু পরীক্ষামুলক ইমিউনোথেরাপী এবং কেমোথেরাপীও নেন স্টাইনম্যান। এই সব চিকিৎসার মধ্য দিয়েই স্টাইনম্যান তার নিজের উপরই বড় পরীক্ষাটা চালিয়ে যেতে থাকেন ঠিক যেভাবে নিজের ল্যাবে গবেষনা পরিচালনা করতেন।
স্টাইনম্যানের নিজের উপর পরীক্ষা করা কয়েকটি পরীক্ষা মুলক চিকিৎসা
খুব সাবধানে নিজের শরীরের ডাটা সংগ্রহ করছিলেন তিনি, বিশেষ করে তার শরীর এই সব চিকিৎসায় কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তিনি পালুকাকে তার ভ্যাক্সিন যে কাজ করছে, তা ইনজেকশন সাইটের চারপাশে ফুলে ওঠা জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন নিয়মিত। যদিও পালুকা নিশ্চিৎ নন তবে তিনিও তার শিক্ষক স্টাইনম্যানের মত জানতেন, ডেনড্রাইটিক কোষগুলোই রোগ প্রতিরোধের সুচনা করে, যদি শরীরের বাইরে এই কোষগুলোকে চিনিয়ে দেয়া যায় কার সাথে যুদ্ধ করতে হবে, এই কোষগুলোই শরীরে ফিরে গেলে টি কোষদের টিউমর ধ্বংশ করার কার্যকরী উপদেশ দিতে পারে। এই যুদ্ধ জয়ে কোষগুলোর পক্ষে সুযোগ বাড়িয়ে দেবার জন্যই মুলত এই প্রচেষ্টা।
ক্যান্সারের যে বায়োমার্কার, বা যা টেষ্ট করে কোন নির্দিষ্ট ক্যান্সারের অগ্রগতি বোঝা যায়, সেটার পরিমাপ দিয়েই স্টাইনম্যানের মনে অবস্থা বোঝা যেত। পুরো চিকিৎসা সময়কাল ধরেই তার এই টিউমর মার্কারটি বার বার ওঠানামা করেছে। রোগী স্টাইনম্যানকে যে সংবাদ খুশী করেছে বিজ্ঞানী স্টাইনম্যানকে তা খুশী করতে পারেনি। তার এই একজন রোগীকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট যে বৈজ্ঞানিক গ্রহনযোগ্যভাবে নয় তাকে সারাক্ষনই হতাশ করেছে। এছাড়া এতগুলো ট্রিটমেন্ট একসাথে, এর সাথে কেমোথেরাপী, ঠিক কোনটা যে তার টিউমার মার্কারে মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে, সেটা বলা সহজ ছিল না। তা সত্ত্বে স্টাইনম্যান বেশ চমৎকার কিছু উপাত্ত রেখে গেছেন, পালুকা একটি ইমিউন মনিটরিং টেষ্ট করার সময় প্রমান পান যে তার শরীরের প্রয় ৮ শতাংশ কিলার টি কোষ সুনির্দিষ্টভাবে তার টিউমরের বিরুদ্ধে কাজ করছে। খুব বেশী মনে না হলেও, আমাদের শরীরের প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হওয়া অসংখ্য রোগজীবানুর বিরুদ্ধে যাদের কাজ করতে হচ্ছে, তাদের মধ্যে ৮ শতাংশ শুধু একটি কাজই করছে ব্যপারটা উডিয়ে দেবার মত না, নিশ্চয়ই কোন একটি চিকিৎসা বা এদের কোনটার সমন্বয় নিশ্চয়ই টিউমরের বিরুদ্ধে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে।
জুন ২০১১, ৪০ তম বিবাহ বার্ষিকী উৎযাপনের স্টাইনম্যান তার স্ত্রী ক্লডিয়াকে নিয়ে রোম বেড়াতে যান। ততদিনে তার প্রথম সার্জারীর চার বছর পেরিয়ে গেছে, এতদিন এই রোগ নিয়ে বেচে থাকাটাই বিস্ময়কর। সেপ্টেম্বর ২০১১ এর মাঝামাঝিও স্টাইনম্যান তার ল্যাবে কাজ করেছেন, আরগোসের চিকিৎসাটা আবার শুরু করার কথা ছিল। সেই সময়ই হঠাৎ করে স্টাইনম্যান নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সেপ্টেম্বর এর ২৪ তারিখ পর্যন্ত্ তিনি তার ল্যাবে ডাটা গুলো রিভিউ করেছেন। কিন্তু অবশেষে শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ৩০ তারিখ আর পারলেন না তিনি। নিউমোনিয়ায় মারা যান ক্যান্সারে দুর্বল হয়ে যাওয়া স্টাইনম্যান।
তখনও তার মৃত্যুর খবর তার নেটওয়ার্কে কাউকে জানানো হয়নি । সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলেন স্ত্রী ক্লডিয়া, তার অসংখ্য সহযোগীদের খবরটা দেবার জন্য। অক্টোবরের ৩ তারিখ, সোমবার সকালেই স্টাইনম্যানের নীরব করে রাখা ব্ল্যাক বেরীতে খবর এলো স্টকহোম থেকে, এ বছরের নোবেল পুরষ্কারের জন্য তাকে মনোনীত করা হয়েছে।
সারা পৃথিবীতে তখন নোবেল কমিটির ঘোষনা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া আসছে। স্টাইনম্যান এবং আরো দুজন ব্রুস বিউটলার এবং জুল হফম্যান কে নানা আর্টিকেল এবং বক্তব্যও প্রকাশিত হতে লাগলো আরো বেশ কয়েক ঘন্টা নাগাদ; স্টাইনম্যানের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হবার আগ পর্যন্ত। নোবেল কমিটি তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে সমস্যায় পড়ে যায়, কারন মরনোত্তর কাউকে পুরষ্কারটি দেয়া হয়না, কিন্তু যদি অক্টোবরে যোষনার পর কোন নোবেল জয়ী ডিসেম্বরের মুল অনুষ্ঠানের আগে মারা যান তবে তিনি বিজয়ীর তালিকায় থাকেন। কিন্তু স্টাইনম্যান মারা গেছেন ঘোষনার মা্ত্র তিন দিন আগে। সেই দিনই দীর্ঘ বৈঠকের পর তারা সিদ্ধান্ত নেন স্টাইনম্যানের নাম নোবেল বিজয়ীর তালিকায় থাকবে।
এর কিছু দিন পর অ্যাপল এর স্টিভ জবস ও ক্যান্সারে মারা যান। খুবই ধীরে ধীরে বড় হওয়া সচরাচর দেখা যায় না এমন একটি ক্যান্সারে, সেটিও স্টাইনম্যানের মত তার প্যানক্রিয়াসে হয়েছিল, প্রায় ৮ বছর বেচে ছিলেন স্টিভ জবস ক্যান্সারটি শনাক্ত হবার পর, এটিও বেশ দীর্ঘ একটি সময়। কিন্তু স্টাইনম্যানের ক্যান্সারটি ছিল আরো ভয়ঙ্কর আগ্রাসী, তার এই বাড়তি সময় বেচে থাকাটা তাই কারো মনে সন্দেহ রাখেনি চিকিৎসায় কোন না কোন কিছু নিশ্চয়ই কাজে লেগেছে।
এখন বিজ্ঞানীরা বুঝতে চেষ্টা করছেন, কি সেটা।
রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ল্যাবে র্যালফ স্টাই্নম্যান (সুত্র: Nature (478) 27 October 2011)
এবছরই কোন এক সময় বেইলর বিশ্ববিদ্যালয় স্টাইনম্যানের সন্মানে তার নামে নামকরন করতে যাচ্ছে তাদের সেন্টার ফর কান্সার ভ্যাক্সিন কে। এবং পালুকা ,যে ভ্যাক্সিন দিয়ে স্টাইনম্যানের চিকিৎসা করেছিলেন সেটাই প্যানক্রিয়াসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছেন। আর্গোসে নিকোলেট আরো জোরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিডনী ক্যান্সারের জন্য তার ভ্যাক্সিন, যা স্টাইনম্যান ব্যবহার করেছিল, সেটিকে ফেজ ৩ এর ট্রায়ালে নিয়ে যাবার জন্য। স্টাইনম্যানের চিকিৎসার সাথে জড়িত সবাই বুঝতে পেরেছেন, ইমিউনিটি অবশ্য তার ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য ঘটিয়েছে। কিন্তু শেষ যে শিক্ষাটি আসলে তাদের শিক্ষক দিয়ে গেছেন, স্টাইনম্যান তার সহকর্মীদের সবসময়ই বলতেন, এখনও অনেক কিছু আবিষ্কার করা বাকী আছে..এবং আসলে তাই।
____________________________
ক্যাথরিন হারমনের The patient Scientist, Scientific American january 2012;
জাক বাঁশোরোর The long arm of the Immune system, Scientific American November 2002;
মিশেল নুসেনযোয়াইগ এবং ইরা মেলম্যান;Ralph Steinman (1943–2011), Immunologist and cheerleader for dendritic-cell biology; Nature (478);27 October 2011;
Dendritic Cells and the Control of Immunity. Jacques Banchereau and Ralph M. Steinman in Nature, Vol. 392; March 19, 1998.
Taking Dendritic Cells into Medicine. Ralph M. Steinman and Jacques Banchereau in Nature,Vol. 449, September 27, 2007.